ইম্পোস্টর সিনড্রোম: কী, কেন এবং কীভাবে মোকাবিলা করবেন?

 

ইম্পোস্টর সিনড্রোম কী


“আমি কি সত্যিই এই জায়গার যোগ্য?”

“ওরা নিশ্চয়ই ভুল করেছে আমাকে সুযোগ দিয়ে।”

“একদিন না একদিন সবাই বুঝে যাবে আমি তেমন ভালো না, আমার দক্ষতা নাই।”


এই প্রশ্নগুলো অনেকের মাথায়ই বারবার ঘুরপাক খায়। আপনারও কি এমন হয়?


তাহলে আপনি একা নন, প্রায় ৭০% প্রফেশনাল মানুষই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এমনটা অনুভব করেন। এটা একপ্রকার মানসিক অবস্থা, যাকে বলা হয় ইম্পোস্টার সিনড্রোম (Impostor/Imposter Syndrome)। 



ইম্পোস্টার সিনড্রোম আসলে কী?


ইম্পোস্টার সিনড্রোম হলো একটি মানসিক অবস্থা যেখানে একজন মানুষ নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা এবং সাফল্যকে অস্বীকার করে। যতই অর্জন থাকুক, ভেতরে ভেতরে একটা ভয় কাজ করে যে - "একদিন সবাই জেনে যাবে আমি আসলে ফ্রড, আমি আসলে কিছুই জানি না।"


এই সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি যতই সাফল্য পাক না কেন, এরা মনে করে -“ভাগ্য, সময় বা অন্যদের সাহায্যেই তা হয়েছে।”


নিজেকে অন্যদের তুলনায় কম যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করে, অথচ বাস্তবে সে অন্যদের সমান বা তাদের চেয়েও বেশি দক্ষ এবং যোগ্য।


১৯৭৮ সালে মনোবিজ্ঞানী পলিন রোজ ক্ল্যান্স এবং সুজান ইমেস প্রথম এই টার্মটি ব্যবহার করেন। প্রথমে মনে করা হতো এটি শুধু সফল নারীদের মধ্যে দেখা যায়, কিন্তু পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে লিঙ্গ, পেশা, বয়স নির্বিশেষে প্রায় সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এমনটা অনুভব করতে পারে।


ইম্পোস্টার সিনড্রোমের প্রধান লক্ষণগুলো


উপরের প্যারাগ্রাফ পড়ে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন এই সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেমন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। 


চলুন এখানে কিছু লক্ষণ নিয়ে বলা যাক:


নিজের সাফল্যকে ভাগ্য বলে মনে করা।

এই ধরনের ব্যক্তিরা সবসময় ভাবে - "আমি লাকি ছিলাম, তাই হয়েছে। আমার তেমন কোনো দক্ষতা বা যোগ্যতা নেই।"


পারফেকশনিজম

এরা সবসময় পারফেকশন খোঁজে। ছোট ছোট ভুলকেও এরা বিশাল ব্যর্থতা মনে করে হাহুতাশ করে।


বেশি বেশি কাজ করা

নিজেকে পারফেক্ট প্রমাণ করার জন্য আদাজল খেয়ে লাগে। এরা মনে করে, বেশি কাজ করলেই হয়তো সবাই বুঝবে সে অনেক দক্ষ। 


কমপ্লিমেন্ট গ্রহণে অস্বস্তি

প্রশংসা শুনলে মনে হয় "ওরা জানে না আমি আসলে কেমন।" নিজেকে সবসময় ছোট মনে করে বিধায় কারও প্রশংসা পেলে অস্বস্তিবোধ করে। 


অন্যদের সাথে তুলনা

এই ধরনের ব্যক্তি সবসময় অন্যদের সাথে নিজের তুলনা করে মানসিক অশান্তিতে ভোগে। এরা ভাবে অন্যরা তার চেয়ে অনেক ভালো জানে।


ব্যর্থতার ভয়

যেহেতু এরা সবসময় পারফেকশন খোঁজে, তাই ব্যর্থতার ভয় পায়। এই ভয়ে তারা নতুন কোনো সুযোগ বা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়, কারণ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়।


ইম্পোস্টার সিনড্রোমের প্রকারভেদ


ডক্টর ভ্যালেরি ইয়াং তার গবেষণায় ইম্পোস্টার সিনড্রোমকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন:


১. দ্য পারফেকশনিস্ট (The Perfectionist)


এরা নিজেদের জন্য অবাস্তব সব স্ট্যান্ডার্ড সেট করে। ৯৯% পেলেও বাকি ১% না পাওয়ায় ভাবে তাতে নিজের ভুল, এজন্য নিজেকে দোষারোপ করে। এই ক্যাটাগরির লোকেরা কন্ট্রোল এবং পারফেকশনে আসক্ত থাকে।


উদাহরণ: একটি প্রেজেন্টেশন সবার কাছে ভালো হলেও একটা স্লাইডের টাইপো নিয়ে সে পুরো রাত ওভার থিংকিং করে ঘুমোতে পারে না।


২. দ্য সুপারহিউমান (The Superhuman)


এরা মনে করে অন্যদের চেয়ে বেশি কঠোর পরিশ্রম করতে হবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। এজন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাজ করে। অতিরিক্ত কাজের ফলে একপর্যায়ে বার্ন-আউটের দিকে এগিয়ে যায়।


উদাহরণ: অফিসে সবার আগে আসা, সবার পরে যাওয়া, তবুও মনে হয় যথেষ্ট হচ্ছে না। তাই ওভারটাইম করার ব্যাপারেও সিরিয়াস থাকে।


৩. দ্য ন্যাচারাল জিনিয়াস (The Natural Genius)


এরা বিশ্বাস করে দক্ষতা সবসময় "প্রাকৃতিক" বা "প্রকৃতি প্রদত্ত" হওয়া উচিত। যদি কোনো কিছু শিখতে সময় লাগে বা বেশি চেষ্টা করতে হয়, তাতেই মনে করে এটা তার জন্য নয়। সেই ক্ষমতা দিয়ে তাকে সৃষ্টি করা হয়নি।


উদাহরণ: কোডিং শিখতে গিয়ে প্রথমবার বাগ পেলেই ভাবে "আমি প্রোগ্রামার হতে পারবো না"।


৪. দ্য সলোইস্ট (The Soloist)


এরা মনে করে সব কিছু একা করতে হবে। হেল্প চাওয়া মানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা বা সেটা নিজের অযোগ্যতা। তাই টিমওয়ার্ক করতে এরা আগ্রহ দেখায় না। কারও হেল্প নিতে চায় না।


উদাহরণ: প্রজেক্টে কোথাও আটকে গেলেও কাউকে জিজ্ঞেস করে না, হেল্প চায় না। কারণ সে ভাবে, যদি জিজ্ঞেস করি বা হেল্প চাই, তাহলে তো সবাই জেনে যাবে আমি পারি না বা আমার দক্ষতা কম।


৫. দ্য এক্সপার্ট (The Expert)


এরা মনে করে সবকিছুই জানা দরকার। কোনো বিষয়ে কম তথ্য না জানলেও বা কোনো বিষয়ে না জানলেও নিজেকে ফ্রড মনে হয়।


উদাহরণ: ইন্টারভিউতে ৯০% প্রশ্নের উত্তর দিলেও যে ১০% পারেনি, সেটা নিয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ- সে একজন ডিজিটাল মার্কেটার। তাকে যদি ওয়েব ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা হয় এবং সেটার উত্তর দিতে না পারে, তাহলেই নিজেকে অযোগ্য ভাবতে থাকে।


ইম্পোস্টার সিনড্রোম কেন হয়?


১. পরিবারের প্রত্যাশা


ছোটবেলায় পারফেক্ট হওয়ার চাপ বা ভাইবোনদের সাথে তুলনা এই মানসিক প্যাটার্ন তৈরি করে। আবার ছোটবেলায় স্কুলে ভালো ছাত্র হওয়ায় সবাই সবসময় তার উপর আশা করতো যে, সে-ই ভালো করবে। 


এই প্রত্যাশার কারণে একপর্যায়ে নিজের মধ্যে পারফেকশনিস্ট হওয়ার চিন্তা ঢোকে। 


২. নতুন পরিবেশ


নতুন চাকরি, নতুন দায়িত্ব, বা উচ্চতর পর্যায়ে গেলে নিজের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করে। ভাবে -  "আমি কি পারবো?", " আমার কি সেই যোগ্যতা আছে?", আমি কি এই পরিবেশে টিকতে পারবো?"


৩. সোশ্যাল মিডিয়া ইফেক্ট


অন্যদের হাইলাইট রিল দেখে নিজের সাথে তুলনা করে। যেমন- কেউ একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একটা ভালো খবর বা সফলতার গল্প শেয়ার করেছে, সেটা দেখে সে ভাবে - "আমি কেন এমন হতে পারছি না", "অন্যরা আমার চেয়ে ভালো পারে"।


কিন্তু এটা তো বোঝা উচিত যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ যা শেয়ার করে বাস্তবে তেমনটা সবসময় ঘটে না। কেউ নিজের একটা ভালো জিনিস শেয়ার করে নিজের দুঃখকে আড়াল করতেও। তাই সোশ্যাল মিডিয়া ইফেক্টও ইম্পোস্টার সিনড্রোমের কারণ হতে পারে। 


কেউ একজন নিজের ভালো কিছু শেয়ার করেছে মানেই যে আপনারও সেটা থাকতে হবে এমন নয়।


৪. মাইনরিটি স্ট্রেস


এটা হয় যখন আপনি আপনার ফিল্ডে একমাত্র নারী, অথবা একমাত্র কমবয়সী কর্মী আর বাকিরা সবাই পুরুষ বা বয়সে বড়। এমন অবস্থায় মনে হবে - "আমি কি তাদের সাথে পারবো? তারা সবাই আমার চেয়ে বেশি জানে।" অথচ আপনার পদ আর তাদের পদ একই লেভেলের। নিজে মাইনর হওয়ায় এমন চিন্তা, মানসিক চাপ অনেকের মধ্যেই আসে।


এই চাপ থেকে পারফেকশনিস্ট হওয়ার চিন্তাও জাগে।


৫. কালচারাল ফ্যাক্টর


আমাদের সংস্কৃতিতে নিজের প্রশংসা করা অহংকার হিসেবে দেখা হয়। তাই আপনার ভালো দক্ষতা থাকার পরও, ভালো কাজ করার পরও প্রশংসা পেলে দোটানায় থাকেন। যা ইম্পোস্টার সিনড্রোম বাড়ায়।


চমকপ্রদ কিছু তথ্য:


• ৭০% মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময় ইম্পোস্টার সিনড্রোম অনুভব করে।

• যারা বেশি সাফল্য পায়, তারা এটাতে বেশি ভোগে। যত সফল, তত বেশি সেলফ-ডাউট।

• নারীরা এমনটা বেশি অনুভব করে। পুরুষরাও সমানভাবে ভোগে, কিন্তু পুরুষেরা এটা কম স্বীকার করে। নারীরা নিজের এই অবস্থার কথা প্রকাশ/স্বীকার করে বেশি।


আলবার্ট আইনস্টাইন, মায়া এঞ্জেলু, টম হ্যাঙ্কস, সেরেনা উইলিয়ামস, মিশেল ওবামা'র মতো ব্যক্তিরা ইম্পোস্টার সিনড্রোম ফিল করেছেন।


মায়া এঞ্জেলু বলেছিলেন: "১১টা বই লেখার পরও প্রতিবার মনে হয়, 'এবার ধরা পড়ে যাব, সবাই বুঝবে আমি ফ্রড'।"


জীবনে ইম্পোস্টর সিনড্রোমের নেগেটিভ প্রভাব


• ক্যারিয়ারে স্থবিরতা। প্রমোশন বা নতুন প্রজেক্টের সুযোগ এড়িয়ে যাওয়া।

• এনজাইটি, ডিপ্রেশন, স্ট্রেস-এর মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।

• বার্নআউট, নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি।

• রিলেশনশিপ সমস্যা, অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলা।

• ব্যর্থতার ভয়ে রিস্ক না নেওয়া।


কীভাবে মোকাবিলা করবেন?


১. ফ্যাক্ট ট্র্যাক রাখুন


নিজের একটা জার্নাল রাখুন। সেখানে প্রশংসা, সাফল্য, পজিটিভ ফিডব্যাক লিখে রাখুন। এটাকে নাম দিতে পারেন "প্রাউড মোমেন্ট জার্নাল"। যখনই নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগবে, তখনই এটা পড়ুন।


২. "ভাগ্য" থেকে "দক্ষতা"-তে ফোকাস করা


"আমি লাকি ছিলাম" বলার বদলে বলুন "আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি এবং সুযোগ কাজে লাগিয়েছি"।


৩. পারফেকশনিজম ছেড়ে দিন


১০০% না পেলেও জীবন থেমে যায় না। পারফেকশন একপ্রকার স্ক্যাম। এই ফাঁদে পড়বেন না। নিজে যতটুকু পারেন, তা দিয়েই শুরু করুন।


৪. শেয়ার করুন


বিশ্বস্ত কারো সাথে আপনার ফিলিংস শেয়ার করুন। দেখবেন তারাও একই অনুভব করছে। তাতে নিজের প্রতি হীনমন্যতা কমবে।


৫. গ্রোথ মাইন্ডসেট গ্রহণ করুন


"আমি জানি না", " আমি পারি না" না বলে ভাবুন "আমি এখনো শিখিনি", " আমি এটা শিখবো"। এমনটা ভাবা বা প্রকাশ করা দুর্বলতা নয়, বরং গ্রোথ মাইন্ডসেটের পরিচয় দেওয়া।


৬. হেল্প চাওয়াও একধরনের সাহসিকতার পরিচয়


প্রশ্ন করা, সাহায্য নেওয়া - এগুলো শেখার লক্ষণ, সাহসিকতার প্রকাশ। সাহায্য চাওয়া মানেই আপনি অযোগ্য নন।


৭. থেরাপি নেওয়ার কথা বিবেচনা করুন


যদি দেখেন ইম্পোস্টার সিনড্রোম আপনার জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, প্রফেশনাল কারও হেল্প নিন।


এর পজিটিভ দিক: 

ইম্পোস্টর সিনড্রোম আসলে একটা লক্ষণ। যেটা আপনার কিছু পজিটিভ দিক তুলে ধরে। 


যেমন:


• আপনি গ্রো করছেন, কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়েছেন।

• আপনি অহংকারী নন।

• আপনি হাই স্ট্যান্ডার্ড রাখেন। ভালো কিছু করার প্রতি আপনি কমিটেড।

• আপনি শিখছেন, এটা গ্রোথ মাইন্ডসেটের প্রকাশ।


মনে রাখবেন,


ইম্পোস্টার সিনড্রোম কখনো সম্পূর্ণ চলে যায় না এবং এটা কোনো মানসিক অসুস্থতা নয়। কেউ না কেউ জীবনের কোনো পর্যায়ে এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে। জীবনের প্রতিটি নতুন লেভেলে, নতুন করে এই মানসিক অবস্থাটি দেখা দিতে পারে। তখন হতাশ হবেন না। কারণ, এখন আপনি জানেন এটা কী, কেন হয়, এবং কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়।


যখন মনে হবে "আমি ফেইক", তখন মনে করবেন যে - এই অনুভূতি নিয়েই আপনি এত দূর এসেছেন। এটা আপনার দুর্বলতা নয়, আপনার গ্রোথের সাক্ষী।


আপনি যোগ্য, আপনি দক্ষ, আপনার সাফল্য আপনার নিজের।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url